সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:৫২ অপরাহ্ন
শিরোনাম:
গাজীপুর আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ জামায়াতের ৫ জন বিজয়ী সারাদেশ গাজীপুরে শিশু বলাৎকারের অভিযোগে গণধোলাইয়ের শিকার ইমামের কারাগারে মৃত্যু ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদসভা গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ৩ গাজীপুরে ট্রেনের পাওয়ার কারে আগুন যানজট নিরসনে গাজীপুর মেট্রোপলিটনের মতবিনিময় সভা সুরাইয়া কবীর সাথীর “আমার যখন ফুরাবে দিন” এখন বাজারে সোনাগাজী উপজেলায় ৪ ইউনিয়নে তাঁতী দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা টঙ্গীতে ❝আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে করণীয় কী❞ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত। জিয়া পরিবারকে ভালোবাসার অপরাধে ২১ মামলার আসামি হয়েছে আব্দুল্লাহ আল আমিন।

আর যাব না তেঁতুলতলা মাঠে

Reporter Name / ১৬৭ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২২, ৬:২৩ পূর্বাহ্ন

 

তেঁতুলতলা মাঠটা আমি চিনি। এমন কোনো মনকাড়া মাঠ নয়। ঘাসহীন ন্যাড়া এই একচিলতে খোলা জায়গাকে অনেকে মাঠ বলতে আপত্তিও করতে পারেন। আশপাশে আবাসিক ভবন, মাঠের কোনার দিকের উল্টো পাশে মসজিদ, মাঠের এক কোনায় একটা পানির পাম্পের মতোও আছে। পাশ দিয়ে চলে গেছে মহল্লার সরু রাস্তা।

ঠিক মাঠের মতো না হলেও ওটা মাঠই। এলাকার শিশু, কিশোর, তরুণ, এমনকি বয়স্কদেরও নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা। আমি দেখেছি এ মাঠে বাচ্চারা সাইকেল চালানো শেখে। ছোট গোলপোস্টে ফুটবল খেলা হয়। চক পাউডারে পপিং ক্রিজ এঁকে হয় ক্রিকেট। শীতকালে হয় ব্যাডমিন্টন খেলা। ঈদে হয় নামাজ।

এলাকার কিশোর-তরুণ বয়সীরা এখানে মাঝেমধ্যে ক্রিকেট, ফুটবলের টুর্নামেন্ট ছাড়ে। অনেক সময় খেলা হয় রাতে, নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা করা ‘ফ্লাডলাইট’ জ্বালিয়ে। তখন কলাবাগানের এই পাড়ায় উৎসবের আবহ ভর করে।

মাঠের পাশে চেয়ার পেতে বসে, দাঁড়িয়ে মা-বোনেরা খেলা দেখেন। মসজিদ থেকে বের হয়ে মুসল্লিরা দাঁড়িয়ে পড়েন খেলা দেখতে। আমি নিজেও অনেকবার এ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলের গতি কমিয়েছি, হেঁটে গেলে দাঁড়িয়ে পড়েছি। বাচ্চাদের খেলা দেখেছি। মনের আনন্দে খেলা বলতে যা বোঝায়, সে খেলাটাই হয় কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে। ঠিক যেমন আমরা ছোটবেলায় খেলতাম।

কুমিল্লা শহরের পাড়ামহল্লায় মাঠের অভাব ছিল না। এক ঠাকুরপাড়াতেই তো কত মাঠ ছিল! মনের আনন্দে খেলার মাঠ। আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করার মাঠ। ঘাসের মাঠ। বালুর মাঠ। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার মাঠ। মদিনা মসজিদ মাঠ। মডার্ন স্কুল মাঠ। বাসার সামনের মাঠ। উঠতি বয়সীদের বিপথে যাওয়া থেকে রক্ষা করার মাঠ। কত যে মাঠ!

আমরা খেলতাম মকবুল স্যারের মাঠে। কুমিল্লা জিলা স্কুলের স্বনামধন্য ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় মকবুল আহমেদ স্যার। তাঁর বাসার সামনে নারকেলগাছে ঘেরা বড় জায়গা ছিল। সেটাই ছিল আমাদের খেলার মাঠ।

স্কুল খোলা থাকলে খেলা হতো বিকেলে। স্কুল বন্ধের সময় সকাল-বিকেল দুই বেলা। চিৎকার-চেঁচামেচিতে স্যারের বাড়ি আমরা মাথায় তুলে রাখতাম। বর্ষাকালে বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলে বাড়িটাকে করে তুলতাম কাদায় মাখামাখি। স্যারের ধবধবে সাদা বাড়িতে কাদামাখা ফুটব।

বাংলাদেশ যখন টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা পায়নি, আমরা তখনো মকবুল স্যারের মাঠে টেস্ট সিরিজ খেলেছি। আবাহনী-মোহামেডান টেস্ট। সেই সিরিজ সর্বশেষ জিতেছিল আবাহনী, যার কালো শিল্ড এখনো আমার কাছে আছে।

এই যে একটা বাড়িতে আমরা ২০ থেকে ২৫ জন শিশু-কিশোর-তরুণ মিলে স্টেডিয়াম বানিয়ে রাখতাম, স্যার কোনো দিন এসে বলেননি, ‘এই, তোরা খেলিস না। আমি এখানে থানা বানাব।’ খেলার মাঠ থেকে আমাদের কেউ কোনো দিন ধরে নিয়ে যায়নি। আমরা নিরাপদে খেলতাম।

স্যার নিজে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখতেন। উৎসাহ দিতেন। মাঝেমধ্যে মজা করে নিজেই হাত ঘুরিয়ে বোলিং করার চেষ্টা করতেন। স্কুলে ইংরেজির জাঁদরেল শিক্ষক বিকেলে হয়ে যেতেন আমাদের খেলার দর্শক।

তেঁতুলতলা মাঠের পাশে দাঁড়ালে আমার মকবুল স্যারের মাঠের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, যখন খেলাটা ছিল আমাদের অভ্যাস, সারা দিনের অপেক্ষা, মনের খোরাক, বিকেলের আনন্দ, ছুটির দিনের রোমাঞ্চ। তেঁতুলতলা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখা মুরব্বিদের দেখলে মনে হয়, ওই তো মকবুল স্যার!

রকম মাঠ বাংলাদেশের সব শহরেই ছিল। কিন্তু শুধু খেলার জন্য খেলার দিনগুলোই তো হারিয়ে গেছে। মনের আনন্দে খেলার মাঠগুলো ভরে গেছে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে। খেলার জন্য খেলতে হলেও এখনকার শিশু-কিশোরদের একাডেমিতে ভর্তি হতে হয়। পাড়ার মাঠ মানেও এখন সংরক্ষিত এলাকা। সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। মাঠ মানে থানার প্লট।

তেঁতুলতলা মাঠে থানা বানানো নিয়ে যা যা হচ্ছে, তা আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেয়, এ দেশে ছোটদের কথা ভাবার লোক তেমন নেই। বিশেষ করে যাঁরা ভাবলে ছোটদের উপকার হয়, তাঁরা ভাবেন না। আমার-আপনার মতো আমজনতা এসব নিয়ে শুধু ভাবতেই পারি, ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে পারি, কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত দিতে পারি না যে তেঁতুলতলা মাঠে খেলাই হবে, থানা হবে না।

যাঁরা সেই সিদ্ধান্ত দিতে পারেন, তাঁরা সমস্যার শুরু থেকে পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। ঘটনা ঘটতে ঘটতে একজন প্রতিবাদী মা আটক হয়ে যান, তাঁর হাফপ্যান্ট-পরা কিশোর ছেলে গারদে ঢুকে যায়, তবু ওনারা ঘটনা পর্যবেক্ষণই করতে থাকেন।

এরপর দেখেন ফেসবুকের সেন্টিমেন্ট, এ নিয়ে আর কে কী বলল। এভাবে চূড়ান্ত জল ঘোলা হওয়ার পর তাঁরা নড়েচড়ে বসে একটা কিছু করেন, যেটা আসলে যতটা শিশু-কিশোরদের কথা ভেবে, তার চেয়ে বেশি বেগতিক পরিস্থিতি সামলাতে। তেঁতুলতলায় অবশ্য এখনো সে ‘সুবাতাস’ও বয়নি।

অথচ তেঁতুলতলা মাঠ থেকে যাঁরা খেলা উৎখাত করতে চাইছেন, তাঁদের ঊর্ধ্বতন মহলের অনেকেই এখন ক্রীড়াজগতেরও লোক। তাঁরা ক্রীড়া ফেডারেশন চালান, খেলার ক্লাব চালান, ক্রিকেট লিগে দল গড়েন। সেই তাঁদেরই লোকজন যখন মাঠে থানা বানাতে ইট-বালু-সিমেন্ট নিয়ে হাজির হন, অবাক হই, তাঁরা কীভাবে দেখেও না দেখে থাকেন!

‘বাংলাদেশের মানুষ ক্রীড়াপ্রেমী’ কথাটাকে এখন ‘মিথ’ বলেই মনে হয়। খেলাটা এখানে পুরোই একটা পোশাকি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাকে ঘিরে ব্যবসা হবে, বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হবে, ভুঁইফোড় সংগঠক গজাবে; অথচ খেলার প্রতি তাদের ভালোবাসা সীমাবদ্ধ থাকবে শুধুই তারকা খেলোয়াড়দের সঙ্গে ফ্রেমবন্দী হওয়ায়। মাঠের খেলা হলো কি না, খেলার মাঠ থাকল কি না; কী আসে-যায় তাতে!

বর্ষপঞ্জিতে থাকা খেলাটা কোনো কারণে না হতে পারলেও সেই খেলার অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ব্যয়বহুল কনসার্ট তাই ঠিকই বৃষ্টিমাথায় হয়ে যায়। খেলার মাঠে চেয়ার পেতে কনসার্ট উপভোগ করেন ‘খেলা খেলা’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা সেই সংগঠকেরা, যাঁরা মাঠের মাটিতে থানার ইট গাঁথতেও দ্বিধাবোধ করেন না।

সভা-সমিতিতে তাঁরাই আবার বলেন শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের কথা। কিন্তু কাজ এমন করেন যে সেই শিশু-কিশোরেরা ভয়ে মাঠ থেকে পালিয়ে যায়। ব্যাট-বলের পরিবর্তে তাদের হাতে ওঠে ট্যাব-মোবাইল অথবা অন্য কিছু। খোলা মাঠ থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা ঢুকে যায় ঘরের চার দেয়ালের ভেতর কিংবা পাড়ার অন্ধকার গলিতে।

আমি তাই ঠিক করেছি তেঁতুলতলা মাঠের দিকে আর যাব না। শেষ পর্যন্ত যদি সেটি আর খেলারই জায়গা না থাকে, গিয়ে কী করব! হয়তো দেখব, নবনির্মিত থানার বারান্দায় হাতকড়া পরে বসে আছে বখে যাওয়া কোনো তরুণ; শৈশব-কৈশোরে যে মনের আনন্দে খেলত তেঁতুলতলা মাঠে।

-প্রথম আলো

বিজ্ঞাপন


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Support By Tanvir Tech