ভারী বৃষ্টি আর উজানের ঢলে সিলেট-সুনামগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, উজান থেকে আসা ঢলে এই বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে চলে গেছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জ। সেখানে বিদ্যুৎ ও মুঠোফোনের সংযোগও নেই।
উজানের এই ঢল সবচেয়ে বেশি এসেছে বৃহস্পতিবার রাতে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের (আইএমডি) তথ্যমতে, সিলেট সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে এক দিনে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১২২ বছরের মধ্যে জুন মাসে এক দিনে সবোচ্চ, এই ঢলে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দারা। পরিস্থিতি বর্ণনায় ৫৫ বছরের শাহজাহান মিয়া মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেছেন, জীবনে কখনোই এত দ্রুততার সঙ্গে পানি বাড়তে দেখেননি তিনি।
শুক্রবার সিলেটের বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মোটামুটি একই চিত্র দেখা গেছে। বানভাসি মানুষেরা জানিয়েছেন, পানি শুধু বাড়ছেই। তাই ঘরে কেউই নিরাপদ বোধ করছেন না। এ অবস্থায় অনেকে হন্যে হয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। অনেকে নৌকার অভাবে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে ঘরে মাচা বেঁধে কোনো রকমে আছেন। কেউ কেউ দিনের বেলা ঘরের চালেও আশ্রয় নিয়েছেন। পরে অবশ্য নৌকাযোগে তাঁরা চাল ছেড়ে বিভিন্ন উঁচু এলাকায় ঠাঁই নিয়েছেন।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার এলাকায় কথা হয় আমেনা বেগমের সঙ্গে। ছয় বছরের নাতিকে কোলে নিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব আমেনা বেগম অসহায় দৃষ্টিতে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন তাঁর ডুবে যাওয়া ঘরের দিকে। তখন অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি নিজের ঘর প্লাবিত হওয়ার কথা বলতে বলতে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। এরপর কেবল চোখ মোছেন। বৃষ্টির পানির সঙ্গে তাঁর গাল বেয়ে পড়া কান্নার রেখাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মিনিট দশেক পর আমেনা বলেন, ‘সব শেষ অই গেছে। ঘর ডুবি গেছে! জিনিসপত্র ভাসি গেছে। কী খাইমু, কই থাকমু?’ এরপর আর কোনো কথাই বলতে পারেননি তিনি। বার কয়েক হাহাকারসূচক শব্দ উচ্চারণ করে তিনি ডুবে থাকা সড়ক ঠাওর করে হাঁটতে থাকেন সামনের দিকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ ছিল। তাই টুকেরবাজার ও আশপাশের অন্তত ১০টি বন্যাকবলিত গ্রামের কয়েক শ মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে হেঁটেই সিলেট শহরের উদ্দেশে রওনা হন। বৃষ্টিতে ভিজে নারী, পুরুষ ও বয়স্ক ব্যক্তিরা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলেন। অনেকের কোলে ছিল বিভিন্ন বয়সী শিশু। কারও কারও মাথায় ছিল বস্তা আর কাপড়ের পুঁটলি। কেউ কেউ গবাদিপশু নিয়ে যাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজে পানিতে হাঁটতে হাঁটতে শীতে কাঁপছিলেন।
জাঙ্গাইল গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী হায়দার রুবেল (৪১) জানান, তাঁদের ঘরে এক দিনের ব্যবধানে কোমরসমান পানি দেখা দিয়েছে। ফলে পরিবারের ১৫ সদস্যের সবাইকে নিয়ে সিলেট শহরের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। সড়ক ডুবে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় হেঁটেই রওনা হয়েছেন। তবে সঙ্গে ছোট বাচ্চারা থাকায় ধীরে ধীরে সতর্ক হয়ে হাঁটছেন। সকাল সাতটায় সদর উপজেলার জাঙ্গাইল থেকে রওনা হয়ে আড়াই কিলোমিটার দূরত্বের পথ টুকেরবাজারে পৌঁছেছেন দুপুর ১২টায়।
বন্যাকবলিত মানুষের হাহাকার ও আজাহারি শুরু হয়েছে। চুলা তলিয়ে যাওয়ায় অনেকের ঘরেই শুক্রবার রান্না হয়নি। এতে খাদ্যসংকটে পড়েছেন অনেকে। সুপেয় পানির সংকটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ–সরবরাহ বন্ধ থাকায় ভোগান্তি আরও বেড়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় গবাদিপশু নিয়ে অনেকে বিপদে পড়েছেন। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও অভুক্ত থাকছে।
সিলেটের উপজেলাগুলোর পাশাপাশি নগরের ২০ থেকে ২৫টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, কালীঘাট, মাছিমপুর, মেন্দিবাগ, উপশহর, তেরোরতন, যতরপুর, সোবহানীঘাট, চালিবন্দর ও ঘাসিটুলা এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অনেক রাস্তায় পানি থই থই করছে। বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। বানের পানির সঙ্গে ভেসে আসছে ময়লা-আবর্জনা। এসব পানি থেকে দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে।
সিলেট নগরের সোবহানীঘাট এলাকার অসংখ্য দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়েছে। মা-মণি এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী ফখরুল ইসলাম এবং শাহজালাল-শাহপরান বেডিং স্টোরের ব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, দুপুরে চোখের পলকেই দোকানে পানি ঢুকে যায়। এতে তাঁদের প্রত্যেকের দোকানে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পানি এখনো বাড়ছে। তাই তাঁরা এখনো ভিজে না যাওয়া মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন
-প্রথম আলো