পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁট পুলিশে চরম অসন্তোষ
পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে বাদ সেধেছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। নিজেরা ইচ্ছেমতো পদোন্নতি নিলেও পুলিশের পদোন্ননিতে তাদের কেন আপত্তি? এ নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক মাস আগে ১৫ জনকে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে গ্রেড-১ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এক জনকেও গ্রেড-১ দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি ৩৪ জনকে গ্রেড-২ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। জনপ্রশাসনে পাশ হয়েছে মাত্র দুটি পদ। আর গ্রেড-৩-এ ১৪০টি পদ চেয়েছিল পুলিশ। পাশ হয়েছে ৫০টি। গত বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে নতুন এই পদের কথা জানানো হয়। এতেই পুলিশে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা চাইলেই তাদের পদোন্নতি মেলে। পদের অতিরিক্ত বহু কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব হয়েও যুগ্ম-সচিবের চেয়ারে বসে কাজ করছেন বহু কর্মকর্তা। অথচ সরাসরি মাঠে জনগণের সঙ্গে কাজ করা পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে কেন তাদের আপত্তি? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে, আন্তঃ ক্যাডার সামঞ্জস্যতা বজায় রাখার স্বার্থে পুলিশের এই পদোন্নতি প্রয়োজন। এই পদোন্নতি হলে পুলিশের উদ্যম ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই প্রস্তাবনা আমলেই নেয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলার এসপি মো. আসাদুজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, ‘পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে পদোন্নতি না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে হতাশা কাজ করছিল। অল্প পদ থাকায় পদোন্নতি নিয়ে নিজেদের দ্বন্দ্ব ও কাদা ছোড়াছুড়ির মতো ঘটনা ঘটছিল। কাজের গতিও কমে যাচ্ছিল। যে কারণে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অসংগতি দূর করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা হলো না। আশা করি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা এটা বিবেচনায় নেবেন। কারণ পুলিশের শীর্ষপদে ক্ষোভ বা বঞ্চনা থাকা কাঙ্ক্ষিত নয়। এতে কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে।”
বাংলাদেশ পুলিশ
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশাসন ক্যাডারে দ্রুত হচ্ছে পদোন্নতি। আবার কোনো কোনো ক্যাডারে পদোন্নতি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। একসঙ্গে বিসিএস দিয়ে কোনো ক্যাডারে কেউ এখনো উপসচিব পদমর্যাদার, আবার প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সচিব। বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির এই বৈষম্যে অন্য সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রায় চার মাস ফাইল চাপা থাকার পর গত বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আশরাফ উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক আদেশে পুলিশে গ্রেড-২-এ দুটি আর গ্রেড-৩-এ ৫০টি পদের অনুমোদন দেওয়া হয়। গ্রেড-১ একজনকেও দেওয়া হয়নি। বর্তমানে পুলিশে গ্রেড-১-এ পাঁচ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এদের মধ্যে আইজিপি, এসবি প্রধান ও পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) পদাধিকার বলে গ্রেড-১ পেয়ে থাকেন। এর বাইরে র্যাব মহাপরিচালক ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারকে গ্রেড-১ দেওয়া হয়েছে। দুই জনই বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা অবসরে গেলে এই পদ বিলুপ্ত হবে। মূলত পুলিশ প্রশাসনে গ্রেড-১ পদের সংখ্যা তিনটি। এবারের নির্দেশনায়ও নতুন কাউকে গ্রেড-১ দেওয়া হয়নি।”
পুলিশের অতিরিক্ত আইজি গ্রেড-২-তে ৩৪টি পদ চাইলেও দেওয়া হয়েছে দুটি। এতে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে পুলিশ। এটাকে তামাশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। তারা বলছেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা পুলিশের সঙ্গে উপহাস করেছেন। এটা না দিলেই বা কী হতো? এতে কি পুলিশ কাজ না করে ঘরে এসির মধ্যে বসে থাকত? তারা তো এসি রুমে বসে সিদ্ধান্ত দেন। আর আমরা রাস্তায় রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জনগণের পাশে থাকি। যত সুযোগ-সুবিধা সবই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই দেওয়া হোক! আমাদের আর পদোন্নতির প্রয়োজন নেই। করোনার সময় কাউকে মাঠে পাওয়া যায়নি। পুলিশই রাস্তায় থেকে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে করোনা মোকাবিলা করেছে। বহু পুলিশ কর্মকর্তা জীবন দিয়েছেন। অথচ কোনো সচিব কাজ করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না।”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসন ক্যাডারে বর্তমানে যুগ্ম-সচিব পদের সংখ্যা ৫০২টি। গত বছরের নভেম্বরে ১৭৫ জন উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম-সচিব করা হয়েছিল। এরপর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২৫ জনে। অনেক যুগ্ম-সচিবকে উপসচিবের পদে কাজ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে গত সোমবার ২১১ জন উপসচিবকে যুগ্ম-সচিব পদে আবারও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এতে যুগ্ম-সচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৩৬ জনে। পদোন্নতি পেলেও তাদের আপাতত যুগ্ম-সচিবের চেয়ারে বসার সুযোগ হচ্ছে না। একইভাবে প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত পদ আছে ২১২টি। এর সঙ্গে সমপর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে প্রেষণে (নির্ধারিত পদের বাইরে অন্যান্য দপ্তর বা সংস্থায় নিয়োগ) থাকা পদ আছে আরও প্রায় ১২৫টির মতো। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত সচিবের পদ দাঁড়ায় ৩৩৭টিতে। গত মে মাসে ১১৪ জন যুগ্ম-সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত সচিবদের সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৪২৬ জনে। অর্থাৎ পদের চেয়ে এখন এই পদে কর্মকর্তা বেশি হয়েছেন।”
পুলিশের সাবেক এক জন কর্মকর্তা বলেন, ‘কোনো ক্যাডারে যদি দ্রুত পদোন্নতি হয়, আর অন্য ক্যাডারে যদি পদোন্নতি হতে বিলম্ব হয় তাহলে মেধাবী ছাত্ররা যেখানে পদোন্নতি দ্রুত হয় সেখানেই যাবে। এতে অন্য ক্যাডারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন—প্রশাসন ক্যাডারে দ্রুত পদোন্নতি হয়, অথচ দেখেন তথ্য ক্যাডারের কী অবস্থা? একই বিসিএসে ঢোকার পর কোনো ক্যাডারে কেউ সচিব, কোনো ক্যাডারে কেউ উপসচিব। এই ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়। কারো কাজ হয়তো সরকারের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে সরাসরি। কেউ হয়তো ঐ পর্যন্ত পৌঁছতেই পারে না। দায়িত্বশীলদের উচিত হবে দ্রুতই এই ধরনের বৈষম্যের নিরসন করা।”
দায়িত্বশীলদের অনেকেই বলছেন, ‘সব ক্যাডারের পদোন্নতির দায়িত্ব প্রশাসন ক্যাডারের হাতে। এটা তো হওয়া উচিত নয়। এখানে বিচার বিভাগের নেতৃত্বে একটা পদোন্নতি কমিটি থাকতে পারে। অথবা সব ক্যাডারের সমন্বয়েও একটা কমিটি হতে পারে। তাহলে সেখানে সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পক্ষে কথা বলার সুযোগ থাকবে। তা না হলে এই ধরনের বৈষম্য থেকেই যাবে। নিজেদের পদোন্নতি তো যে কেউ আগে করে নেবেন। এটা ঠিক নয়। তবে এখন যেটা করা হচ্ছে, সেটা অনুচিত। মহাকাশ গবেষণায় পাঠানো হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডারের লোকজনকে। আবার যেখানে ডাক্তার থাকার কথা সেখানেও পাঠানো হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডারকে। এটা তো ঠিক না। তাদের এত পদোন্নতি হয়েছে যে, আসলে বসানোর কোনো জায়গা নেই।”